তোমার বাচ্চা হয় না কেন?

“তোমার যৌন জীবন কেমন যাচ্ছে?”- এটা জিজ্ঞেস করার একটা ভদ্রোচিত উপায় হচ্ছে কিছু সহজ প্রশ্ন করে ফেলা। যেমন- বাচ্চা নাও না কেন, অথবা বাচ্চা হচ্ছে না কেন? বাচ্চার নেয়ার ইচ্ছা নেই? বাচ্চা হওয়ার জন্য কী করছো?

আমাদের সমাজে এটা নিত্যদিন ঘটে। ভদ্রতার সকল সীমারেখা অতিক্রম করে এই প্রশ্নগুলো প্রতিনিয়তই অনেক মানুষের মুখে মুখে ফেরে। দম্পতিদের তো বটেই, বিবাহিতা-অবিবাহিতা সব মেয়েকেই প্রতিনিয়ত এই প্রশ্নটি শুনতে হয়। যেন নারীর জীবনে বিয়ে করার একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে সন্তান উৎপাদন করা। আর নারী যদি নিঃসন্তান হয়, তাহলে তো কথাই নেই।

-এখনো বিয়ে করো নাই? বাচ্চা নিবা কবে? বয়স হয়ে যাচ্ছে তো!
-আমরা কবে খালা/মামা/চাচা/ফুপু হবো?
-এইবার আমাদের নানা-নানী/দাদা-দাদী বানাও!
-একটা জুনিয়র নিয়ে আসো।
-বাচ্চা হইলে বুঝবা বাচ্চার কি সুখ!
-বাচ্চা ছাড়া মেয়ে মানুষের জীবনের কোন দাম আছে নাকি!!
-এখনো বাচ্চা হয় নাই? ডাক্তার দেখাইসো? কার সমস্যা?
-বাচ্চা না হলে বুড়া বয়সে দেখবে কে? বাচ্চা হচ্ছে ভবিষ্যৎ।
-বাচ্চা ছাড়া মেয়ে মানুষ হচ্ছে ফল ছাড়া গাছ। সেই গাছের মুল্য নাই।
-তাড়াতাড়ি বাচ্চা নাও। বাচ্চা না থাকলে স্বামীও ভালোবাসে না। বাচ্চা হচ্ছে সংসারের খুঁটি।

ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি…

কথাগুলো আমরা বলে ফেলি বটে, কিন্তু আগেপিছে ভেবে বলি কি? আমার প্রায়ই মনে হয়, কিছু মানুষ আরেকজনকে আঘাত করার জন্য বা খোঁচা দেবার জন্যেই কথাগুলো বলে থাকেন। এখানে সন্তান নিয়ে উৎকণ্ঠার চাইতে আঘাত করার চেষ্টাটাই মুখ্য। হয়তো আরেকজনের যৌন জীবন নিয়ে কথা বলে মনে মনে কোন অসুস্থ তৃপ্তি পান, যা নিতান্তই অনুচিত।

কারণ প্রথমত, কোন দম্পতি সন্তান নেবে কি নেবে না, সেটা একান্তই তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। অন্যের ব্যাপার সারাক্ষণ নাক গলানো যদিও বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হয়ে আছে, কিন্তু এটা আসলে খুবই কুৎসিত কাজ। আপনি যেই-ই হোন না কেন, কোন দম্পতির শোবার ঘরে কী হচ্ছে সেটা জানা আপনার কাজ নয়। ব্যাপারটি অরুচিকর এবং কদর্য।

নারীর শরীর, মা হবেন কি হবেন না, হলেও কখন কবে কীভাবে হবেন সেটা নারীর সিদ্ধান্ত। হ্যাঁ, আমাদের সমাজ এখনও এটা বোঝে না। এখনো এদেশে বিয়ের পর পরই মাতৃত্বের দায় চাপিয়ে দেয়ার জন্য স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি হতে শুরু করে আত্মীয় স্বজন, পাড়া-মহল্লার মানুষ পর্যন্ত উদগ্রীব হয়ে ওঠে। মেয়েটিকে কেউ জিজ্ঞেস করে না যে সে কী চায় বা তাঁর কী ইচ্ছা। ফলাফল, বহু মেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মাতৃত্বের শিকার। মা ও শিশু দুজনেরই সীমাহীন কষ্ট। সাথে ব্যর্থ সম্পর্ক, শারীরিক অসুস্থতা, মানসিক বিপর্যয়, অল্প বয়সে মা হয়ে আরও নানান কষ্টের মাঝ দিয়ে যাওয়া। একজন নারীর কি সত্যি এটা প্রাপ্য? নিজের শরীরের সাথে কী হবে, কখন সন্তান নেবেন কি নেবেন না, সেই সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার কি নারীর আসলেই নেই?

সন্তান ছাড়া নারী জীবন বৃথা- এই চিন্তা করে কেউ আনন্দ পেতে চাইলে নিঃসন্দেহে পেতে পারেন, তবে আরেকজনের জীবনের সাথে সেটা না মেলানোর চেষ্টা করাই বোধহয় ভালো। আপনার জীবন সন্তান ছাড়া বৃথা হতে পারে, কিন্তু সকলের ক্ষেত্রে সেটা সত্য নয়। জন্ম, খাওয়া, যৌনতা, সন্তান জন্ম, মৃত্যু ইত্যাদি হচ্ছে জৈবিক জীবনের বেসিক রুল। মানুষ সহ পৃথিবীর প্রত্যেক জন্তু, জানোয়ার, পাখি এইসব করে। উদ্দেশ্য একটাই- পৃথিবীতে বংশগতির ধারা সচল রাখা। তাই কারো সন্তান না থাকলে (বা না হলে) তাঁর জীবন বৃথা, এইসব নিচু কথা বলে বলে কাউকে আঘাত করা কুৎসিত মানসিকতার পরিচায়ক। জীবনের অন্যান্য সব কিছুর মতই সন্তানও একটা অংশ, যেটা থাকবে কি থাকবে না সেটা কম দম্পতির ব্যক্তিগত ইচ্ছা। কিন্তু না থাকলে কারো জীবন ব্যর্থ হয়ে যায় না। মানুষের জীবন এত ক্ষুদ্র নয় যে কেবল সন্তান না থাকলেই অর্থহীন হয়ে যাবে।

কারো সন্তান নেই মানে তাঁদের সন্তান হচ্ছে না এবং তাঁরা সন্তানের জন্য হাহাকার করে মরছে- এইসব চিন্তা হচ্ছে অন্যতম কুশিত আরেকটি ব্যাপার। সন্তান নেয়া, না নেয়া ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। সন্তান নেই বলেই পৃথিবীর সবাই হাহাকার করছে, এই চিন্তাটা খুবই ক্ষুদ্র। মানুষ মাত্রই তাঁর চিন্তা চেতনা, চাওয়া পাওয়া, আকাঙ্ক্ষা সব ভিন্ন। কেউ সন্তান খুব ভালোবাসেন, ঘর ভরা মিষ্টি মিষ্টি শিশু তাঁর- এটা যেমন দোষের না। তেমনই কোন দম্পতি সন্তান চান না বা এই মুহূর্তে চাইছেন না- সেটাও দোষের না। আর তাই সন্তান না চাইলেই এক যোগে তারা খারাপ মানুষ, বা সন্তান জন্মদানে অক্ষম মানুষ- এটা ভাবাও ছেড়ে দিন

বিয়ে মানেই সন্তান জন্ম দেয়া না। কিংবা সন্তান জন্ম দেয়ার জন্যই কেবল মানুষ বিয়ে করে না। আমাদের দেশে ব্যাপারটা হয়তো সেটাই বেশীরভাগ মানুষের কাছে। কিন্তু সত্য এটাই যে বিয়ে মানে দুটি মানুষ একসাথে তাঁদের জীবন কাটাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেটা ঘর ভরা ফুটফুটে শিশু নিয়ে কাটানো ছিমছাম সংসার জীবন হতে পারে, আবার কায়রোর মরুভুমিতে ট্রাভেলারের জীবনও হতে পারে। তাঁরা কীভাবে সংসার করতে চান, সেটা তাঁদের ওপরেই ছেড়ে দিন। সন্তান না হলে সংসার টিকবে না, এমন ভাবাটা নেহাতই মূর্খতা। সন্তান ছাড়া যে সংসার ভেঙে যাবার উপক্রম হয়, সেটা বোধয় ভেঙে যাওয়াই ভাল।

সন্তান মানেই সুখী দাম্পত্য জীবনের গ্যারান্টি না। যদি হতো, পৃথিবীর বেশীরভাগ দম্পতি সুখী হতো এবং সন্তান না থাকা সমস্ত দম্পতির নিশ্চিত ডিভোর্স হয়ে যেত। সেটা কি হয়েছে? হয়নি! অসংখ্য নিঃসন্তান দম্পতি কেবল পরস্পরের ভালোবাসা নিয়েই বেশ আছেন। অনেক সন্তান থাকার পরেও কত দম্পতির মাঝে এক বিন্দু মনের মিল নেই। দাম্পত্য সুখের হবে কি হবে না, সেটা মানুষ দুটির ওপরে নির্ভর করে, সন্তানের ওপরে না। একইসাথে সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা কোন ব্যর্থতা নয় যে এর কারণে ক্রমাগত কাউকে অপমান-অপদস্থ করার অধিকার কেউ রাখে। বাঞ্জা, বন্ধ্যা, আঁটকুড়ে এইসব কুৎসিত শব্দ অনেকেই ব্যবহার করেন অন্যকে উপহাস করতে। কখনো ভেবে দেখেছেন কি, তাতে আপনার সম্মান কোথায় যায়?

আর হ্যাঁ, বাচ্চা বুড়ো কালের টিকিট না যে এখনোই কেটে না ফেললে বুড়ো বয়সে হাহাকার করতে হবে!! বাচ্চাকে যারা বুড়ো কালের টিকিট ভাবেন, ভবিষ্যতের ইনভেস্টমেন্ট ভাবেন, তারা মূলত পিতা-মাতা হবার যোগ্যই নন। শিশুর জন্ম হবে দুজন মানুষের গভীর ভালোবাসা থেকে, প্রাইজ বন্ড কিনে ভবিষ্যতের সঞ্চয় রাখার মত করে নয়। তাই না? আজ যদি সন্তানকে ভবিষ্যতের ইনভেস্টমেন্ট ভাবেন, কাল কিন্তু এই সন্তানই আপনাকে বোঝা মনে করবে।

পরিশিষ্ট
সমাজে প্রচলিত সকল রীতিনীতিই যে সঠিক বা সম্মানের যোগ্য, ব্যাপারটি কিন্তু আজকাল আর তেমনটি নেই। নতুন প্রজন্ম নতুন করেই ভাবতে শিখেছে, বাইরের পৃথিবীর সাথে নিজেদেরকে মিলিয়ে ভালোমন্দ যাচাই করতে শিখেছে। ফলে অনেক পুরাতন ধ্যান-ধারণাই সময়ের সাথে সাথে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। তাই অকারণে আরেকজনের দাম্পত্য জীবন নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য বা উপদেশ দেবার আগে ভাবুন-

এই কথাগুলো কেউ আপনাকে বললে সহ্য করতে পারবেন কি?
মনে রাখবেন, অন্যকে কুৎসিত কথা বললে আপনার সম্মান বাড়ে না। বরং সম্পর্কগুলো নষ্ট হয়।

দিন বদলাচ্ছে, আধুনিক দম্পতিরা নিজেদের দাম্পত্যের সীমারেখা নিজেরাই নির্ধারণ করে। এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারলে দিনশেষে স্থান হবে সময়ের আবর্জনায়। তাই আসুন, নতুন করে ভাবতে শিখি। অন্যের প্রাইভেসিকে সম্মান করি।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও তরুণ উদ্যোক্তা। প্রিয়.কমে নিয়মিত ব্লগ লিখছেন ‘বোকা মেয়ের ডায়েরি’ শিরোনামে।